রায়পুর প্রতিনিধি :
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চরপাতাসহ (স্মার্ট গ্রাম) বিভিন্ন এলাকায় স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বিপজ্জনক কিশোর গ্যাং ও মাদক সেবনের-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় অভিভাবকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
দিন দিন এদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনসহ সচেতন মহল। উপজেলায় রয়েছে কিশোর গ্যাং এর একাধিক গ্রুপ। এসব গ্রুপ বিভিন্ন নামে পরিচিত। পশ্চিমা কালচারের অনুকরণে এসব গ্রুপ গড়ে উঠেছে।
বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দুপুরে উপজেলা আইনশৃংখলা সভায় স্থানীয় এমপি নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের উপস্থিতিতে জনপ্রতিনিধি সুলতান মামুন রশীদ ও এক শিক্ষক শংকর মজুমদার চরপাতা গ্রামে ইভটিজিং, মাদক সেবন-বিক্রি ও বখাটেপনার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়ার আহবান জানান।
এছাড়াও বুধবার (১৭ এপ্রিল) দুপুরে এই কিশোর গ্যাংদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিতে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং থানার ওসির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই গ্রামের ১৩০ জন সচেতন তরুন ও যুবসমাজ।
সম্প্রতি চরপাতা ইউনিয়ন পরিষদের নামে ও বিভিন্ন ব্যাক্তির আইডি থেকে (ফেইসবুক- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম) কয়েকজন তরুনের ছবি ও তাদের কার্যক্রম দিয়ে সবাইকে সতর্ক করছেন।
২০২৩ সালের ১৪ মার্চ বিকেলে দেশের দ্বিতীয় ‘স্মার্ট ভিলেজ’ লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে চরপাতার গ্রামেকে উদ্বাধন করেন লক্ষ্মীপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন আকন্দ। পরের দিন থেকে কয়েকটি স্থানে শুরু হয় কিশোর গ্যাংদের উৎপাত। সেই সাথে ইয়াবা সেবন, বিক্রি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে ছাত্রীদের সাথে ইভটিজিং। অপহরনের মত অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো এলকার মানুষের মধ্যে উদ্বেগ এবং উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।।
চরপাতার গ্রামের ওইসব মাদকাসক্ত ও ইভটিজাররা হলো: চরপাতা গ্রামের রুস্তম আলী ডাক্তার বাড়ির ফিরোজের ছেলে মোঃ মাসুম। বর্তমান সে ইয়াবা চক্রের মূল হোতা, ডিলার, সরবরাহকারী এবং মাদক সেবী। থানার তালিকাভুক্ত ফেরারি আসামী। তার অধীনে তৈরী হয়েছে কিশোর গ্যাং, অপহরন চক্র। তারই শীস্য অপহরনকারী রিপাত হাসান তারই সৃষ্টি। ৯ নাম্বার ওয়ার্ডের মোস্তান বাড়ীর আব্বাস মোস্তানের ছেলে রিপাত হোসেন। সে কিশোর গ্যাং, ইভটিজার, মাদকসেবী ও অপহরণকারী হিসেবে এলাকায় চিহ্নিত। সম্প্রতি ৭নং ওয়ার্ডের মুন্সিয়ার বাড়ির হানিফের ছেলে তামভীরকে অপহরণ করে এক কোটি টাকা মুক্তিপন দাবি করে রিপাত। এঘটনায় জানতে পেরে পুলিশ আটক করে। ৭ নাম্বার ওয়ার্ডের পাটোয়ারী বাড়ীর আহসান উল্লাহর ছেলে রুবেল, জুয়েল ও জীবন। তারা এলাকায় চুরি, ডাকাতি, ইয়াবা সরবরাহকারী এবং সেবনকারী হিসেবে পরিচিত। এলাকার কোন মানুষ প্রতিবাদ করলেই মিথ্যা মামলার হুমকি দেয়, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে জিম্মি করে রাখে। তিন ভাইয়ের অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ট ও ভীত সন্তষ্ট থাকছে।
একই ওয়ার্ডের গাজি বাড়ীর তোফায়েলের ছেলে হান্নান ও শাকিল পুলিশের তালিকাভুক্ত ফেরারি আসামী।
তারা মাদক সেবনকারী, সরবরাহকারী ও কিশোর গ্যাং এর সদস্য। এই দুই ভাই নতুন প্রজন্মকে মাদক সেবন ও ব্যবসায় উৎসাহিত করছে। মোল্লা বাড়ীর আবদুল মজিদের ছেলে ইয়াবা ব্যাবসায়ী কানা বাবু পুলিশের তালিকাভুক্ত ফেরারি আসামী।
এলাকাবাসী জানান, ৭নং ওয়ার্ডের জনৈক নারী মুনাফার শর্তে ইয়াবা ডিলারদের অর্থ সরবরাহ ছাড়াও কিশোর গ্যাং, ইভটিজিং ও অপহরণ চক্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান।।।
রায়পুর থানার ওসি ইয়াসিন ফারুখ মজুমদার আইনশৃংখলা সভায় জানান, চরপাতা ও বামনী ইউপির চেয়ারম্যান ও ১৩০ জন তরুন ও যুবক মাদক এবং ইভটিজিংয়ের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। দুই মাদক ব্যাবসায়ী ও ইভটিজারকে আটক করেছি। অন্যদের বিষয়ে গ্রেপ্তার অভিযান চলছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শহরকেন্দ্রিক এবং চরপাতা গ্রামের কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা জড়ো হয় গাজি কমপ্লেক্স, মার্চেন্টস একাডেমির সামনে, সরকারি কলেজের সামনে, মহিলা কলেজের আশেপাশে, নতুনবাজার, বামনী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে, কাপিলাতুলি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে, চরপাতা ইসহাকিয়া মৈত্রী বিদ্যালয়ের সামনে, গাজিনগর বাজার ব্রীজের ওপর, মজিবুল হক একাডেমির সামনে, চরপাতা ইউপি পরিষদের আশেপাশে, বোয়াডার বাজার ও শেখ কামাল শিশু পার্কের সামনেসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোটো-বড়ো কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।
এদের মধ্যে আধিপত্য, মাদক, নারী, স্ট্যান্ড দখল, সিনিয়র-জুনিয়রসহ নানা ধরনের ছোটো খাটো বিষয় নিয়ে দেশিয় অস্র নিয়ে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, মারামারি ঘটনাও ঘটছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন স্কুল-কলেজের মোড়ে বা অলি-গলির চা দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য ইভটিজিং এবং বীরদর্পে সিগারেট ফুঁকালেও কেউ কিছু বলার সাহস করে না। এরা বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী বা স্কুলছুট হওয়ায় এদের বয়স ১৩ থেকে ১৯-এর মধ্যে।
চরপাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান মামুন রশীদ বলেন, কিশোর গ্যাং দেশের অপরাধ জগতের নব আবির্ভূত এক অপরাধী চক্র। বখাটে কিছু কিশোর ও মাদক ব্যাবসায়ী দলবন্ধ হয়ে আমার ইউনিয়নে চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ ও ইভটিজিং এমনকি খুন খারাবির দিকে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
তিনি আরো বলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা নিতে মাসিক আইনশৃংখলা সভায় আমিসহ এলাকার ১৩০ তরুন, যুবক ও অভিভাবক এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ওসির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
এ বিষয়ে রায়পুর থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইয়াসিন ফারুখ মজুমদার বলেন, কিশোর গ্যাং বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। চরপাতা ও বামনী ইউপির চেয়ারম্যান এবং চরপাতা গ্রামের ১৩০ তরুন ও যুবক লিখিত অভিযোগ করেছেন। মানবিক বিষয়টি সামনে রেখে প্রথমে কাউন্সেলিং করা এবং শেষ পর্যায়ে আসে অ্যাকশনের বিষয়টি। কারা জড়িত এবং তাদের লিডার কে-এসব খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর) আসনের এমপি নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন বলেন, আইনশৃংখলা সভায় চরপাতা গ্রাম (স্মার্ট গ্রাম) সহ বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাং, ইভটিজার, মাদকসেবি ও ব্যাবসায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিতে ইউএনও ও ওসিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।